ভারতের রাষ্ট্রপতি(President of India)

  • ভারতীয় সংবিধানের ৫২ নং ধারা অনুযায়ী ভারতের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন[There shall be a president of India- Article-52]।
  • রাষ্ট্রপতি দেশের শাসনতান্ত্রিক প্রধান ।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ( ধারা ৫৪ ও ৫৫)

  • রাষ্ট্রপতি ভারতীয় জনগণ দ্বারা পরোক্ষ ভাবে নির্বাচিত হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন একটি নির্বাচনী সংস্থা বা ইলেক্টোরেল কলেজ দ্বারা। এই সংস্থাটি তৈরি হয়-
    • ভারতীয় সংসদের উভয়কক্ষের(লোকসভা ও রাজ্যসভা) নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা।
    • বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা।
    • কেদ্রীয় শাসিত অঞ্চল হলেও দিল্লী ও পুদুচেরির বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে ।
  • ৫৫ নং ধারায় রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি, বিধানসভা ও সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের ভোটমূল্য ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে।
  • যে পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন হয়, তার সাংবিধানিক নাম হল 'একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব' (Proportional Representation by means of single transferable vote) ।
  • রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজন এবং গণনার দায়িত্ব ভারতের নির্বাচন কমিশনের।
  • রাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন বিতর্ক সৃষ্টি হলে সুপ্রিম কোর্ট তার সমাধান করে।

রাষ্ট্রপতির কার্যকাল(ধারা ৫৬ ও ৫৭)

  • তাঁর কার্যকাল পাঁচ বছর । মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত নিজের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
  • মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ পারেন এবং সেক্ষেত্রে উপরাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করতে হবে।
  • ৫৭ নং ধারা অনুসারে একই ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে পুননির্বাচিত হতে পারেন। কতবার নির্বাচিত হতে পারবেন তার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।

রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর যোগ্যতা(ধারা-৫৮):-

  • রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে অবশ্যই ভারতের নাগরিক হতে হবে ।
  • তাঁর বয়স অন্তত ৩৫ বছর হতে হবে ।
  • তাঁকে লোকসভায় নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে ।

রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর শর্তাবলী(ধারা-৫৯):-

  • রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত কোন ব্যক্তি সংসদ বা রাজ্যবিধান সভার সদস্য হতে পারবেন না । সংসদ বা রাজ্যবিধান সভার কোন সদস্য যদি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন তাহলে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার পূর্বে উক্ত পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে।
  • রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হওয়ার সময় তিনি কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের অধীনে কোনও লাভজনক পদে নিযুক্ত থাকতে পারবেন না ।

রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ(ধারা-৬০):-

  • ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির উপস্থিতিতে বা তাঁর অনুপস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতির উপস্থিতিতে শপথ নেন ।

রাষ্ট্রপতির অপসারণ/ইমপিচমেন্ট(ধারা-৬১):-

  • শুধুমাত্র সংবিধান বিধিভঙ্গের অপরাধে রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করা যায়।
  • অপসারণ/ইমপিচমেন্টের প্রস্তাব সংসদের যেকোনো কক্ষে উত্থাপিত করা যায়।
  • প্রস্তাবটি উত্থাপিত কক্ষের এক-চতুর্থাংশ দ্বারা স্বাক্ষরিত হতে হয়।
  • প্রস্তাব উত্থাপনের অন্তত ১৪ দিন পূর্বে রাষ্ট্রপতিকে নোটিস হিতে হয়।
  • প্রস্তাবটি উত্থাপিত কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হলে, প্রস্তাবটি অপর কক্ষে প্রেরণ করা হয়। অপর কক্ষেও দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হয়।
  • সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচিত ও মনোনীত সদস্যরা এই প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে। রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের(দিল্লী ও পুদুচেরি) বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা এক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করতে পারেনা।
  • ভারতের কোন রাষ্ট্রপতিকেই এখনও পর্যন্ত অপসারিত করা হয়নি।

রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য(ধারা-৬২):-ভারতীয় রাষ্ট্রপতির পদটি নিম্নলিখিত কারনে শূন্য হতে পারেঃ

  • রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে
  • রাষ্ট্রপতিকে অপসারিত করা হলে
  • রাষ্ট্রপতির মৃত্যু হলে
  • রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতির অবর্তমানে প্রধান বিচারপতি, প্রধান বিচারপতির অবর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতি রাষ্ট্রপতি হিসাবে কাজ করবে। শূন্যতার ৬ মাসের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলীরাষ্ট্রপতি ভারতের সাংবিধানিক প্রধান এবং সেই সূত্রে তিনি সর্বময় প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী হলেও আসল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের হাতে ন্যস্ত । প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীমন্ডলী এবং সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে সকল নির্দেশিকা জারি হয় রাষ্ট্রপতির নামে । ভারতের সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে যেসকল ক্ষমতা প্রদান করেছে সেগুলি হল—

(১) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা:-

  • রাষ্ট্রপতি যাদের নিয়োগ করেন তারা হল-
    • প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী
    • অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল
    • সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি
    • অ্যাটর্নি জেনারেল, কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল(CAG), UPSC-এর চেয়ারম্যান, নির্বাচন কমিশন, অর্থ কমিশন প্রভৃতির সদস্যদের
  • তিনি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের প্রধান প্রশাসক।
  • কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদ রাষ্ট্রশাসন ও পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ও সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতিকে জানাতে বাধ্য থাকেন ।

(২) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা :-

  • রাষ্ট্রপতি লোকসভা গঠন, লোকসভার অধিবেশন আহ্বান প্রয়োজনে মুলতুবি ইত্যাদি করতে পারেন ।
  • রাষ্ট্রপতি লোকসভায় দুজন ও রাজ্যসভার ১২ জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সদস্য মনোনীত করতে পারেন।
  • তাঁর সম্মতি ছাড়া কোনো বিল আইনে পরিণত হতে পারে না ।

(৩) ভেটো প্রদান ক্ষমতা :- ভেটো একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ 'আমি নিষেধ করছি'। সংসদে পাস হওয়া কোন বিলের ওপর রাষ্ট্রপতি ভেটো প্রয়োগ করতে পারেন। ভেটো চার প্রকারের হলেও রাষ্ট্রপতি তিন প্রকারের ভেটো প্রদান করতে পারেন (১, ২ ও ৪)-

  • (১)অ্যাবসোলিউট ভেটো[Absolute Veto]:যখন রাষ্ট্রপতি একটি বিলকে সম্পূর্ণ ভাবে খারিজ করে দেন তখন অ্যাবসোলিউট ভেটো প্রদান করেন।
  • (২)সাসপেন্সিভ ভেটো[Suspensive Veto]:এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ভেটো প্রয়োগ করে বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে প্রেরণ করেন। কিন্ত বিলটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পরিবর্তিত বা অপরিবর্তিত অবাস্থায় সংসদ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে ফিরে এলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি জানাতে বাধ্য থাকেন।
  • (৩)কোয়ালিফায়েড ভেটো[Qualified Veto]:এক্ষেত্রে ফেরত পাঠানো বিলটি পূর্বের থেকে বেশী সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হলে তাতে সম্মতি জানানো বাধ্যতামূলক হয়।
  • (৪)পকেট ভেটো[Pocket Veto]:এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতি বা অসম্মতি কিছুই না জানিয়ে বিলটিকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রেখে দিতে পারেন।

(৪) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা :-

  • রাষ্ট্রপতির পূর্ব সম্মতি ছাড়া অর্থ বিল বা রাজস্ব বিল উত্থাপিত হতে পারে না।
  • তার পূর্ব সম্মতি ছাড়া কর, অনুদান বা ঋণ সংক্রান্ত বিল সংসদে উত্থাপন করা যায় না।
  • ভারতীয় অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির হয়ে সংসদে বাজেট পেশ করেন ।
  • রাষ্ট্রপতির হাতে থাকা রাষ্ট্রের আকস্মিক ব্যয় সংকুলান তহবিল(Contingency Fund) থেকে তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করতে পারেন ।
  • প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তিনি অর্থ কমিশন গঠন করেন।

(৫) জরুরি ক্ষমতা :-

ভারতের সংবিধান অনুসারে তিনটি বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন, একে রাষ্ট্রপতির জরুরি ক্ষমতা বলে, যেমন—
  • (ক) জাতীয় জরুরি অবস্থা(ধারা ৩৫২)
  • (খ) অঙ্গরাজ্যে শাসনতান্ত্রিক জরুরী অবস্থা(ধারা ৩৫৬ ও ৩৬৫)
  • (গ) আর্থিক জরুরী অবস্থা(ধারা ৩৬০)

(৫) ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা :-

  • পার্ডনঅপরাধীকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দেওয়া।
  • রিপ্রাইভসাময়িক ভাবে শাস্তি প্রদান স্থগিত রাখা।
  • রেসপাইটঅপেক্ষাকৃত কম কঠোর শাস্তি প্রদান করা।
  • রেমিশনএক্ষেত্রে শাস্তির ধরন বা প্রকৃতি না বদলে শুধুমাত্র সময়কালকে কমানো হয়।
  • কমিউটেশনএর মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে কোন কঠোর শাস্তিকে অপেক্ষাকৃত কম কঠোর শাস্তিতে বদলে দেওয়া হয়।
  • মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করার সাংবিধানিক অধিকার শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতিরই আছে।

(৬) কূটনৈতিক ক্ষমতা :-

  • সমস্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, কনভেনশন বা প্রোটোকল ইত্যাদি রাষ্ট্রপতির নামে বা তাঁর মাধ্যমেই সম্পাদিত অর্থাৎ স্বাক্ষরিত হয়।
  • তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রে দূত, হাই কমিশনার ইত্যাদি কূটনৈতিক প্রতিনিধি প্রেরণ করেন।
  • বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আগত কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের তিনি স্বাগত জানান।

(৭) সামরিক ক্ষমতা :-

  • তিনি ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (Supreme Commander)।
  • তিনি স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ করেন।
  • সংসদের সম্মতিতে তিনি কোন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপন করতে পারেন।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ

  • রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর মনোনয়ন পত্র পঞ্চাশ জন নির্বাচকের দ্বারা প্রস্তাবিত এবং পঞ্চাশ জন নির্বাচকের দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।
  • রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে ১৫০০০ টাকা জামানত হিসাবে জমা করতে হবে।
  • স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ।
  • ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ একমাত্র রাষ্ট্রপতি যিনি পরপর দুবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
  • নিলম সঞ্জীব রেড্ডি ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রপতি যিনি কোন প্রতিদ্বন্ধিতা ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
  • ডঃ জাকির হোসেন ভারতের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রপতি।
  • প্রতিভা পাটিল ভারতের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি।